মিস্টেরিয়াস লাইন

সুন্দর আসবাবপত্রে সাজানো একটি অফিসের কামরায় বসে আছি। একটি বড় কোম্পানীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (CEO) রুম বলে কথা। কথায় কথায় তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা রাসেল, বলতো আমাদের এই নতুন প্রোডাক্টটা কিভাবে মার্কেটিং করা যায়? প্রোডাক্টটা কিছুক্ষণ হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলাম। সুন্দর একটা জার (jar)। ভেতরে চকোলেটের মতন দেখতে নরম একটা চকোলেট ক্রিম। প্রোডাক্টটার নাম ছিল নটিলা, যেটা সাধারণত বাচ্চারা পাউরুটি বা বন দিয়ে খায়৷ কিছু কিছু বাচ্চা তো আবার হাত বা চামচ দিয়েও খেয়ে ফেলে।

তিনি আবারো জিজ্ঞাসা করে বসেন, কিছু আসলো মাথায়? সাথে সাথে আমি বললাম, আচ্ছা দাদা ইম্প্যাক্ট (impact) মার্কেটিং করলে কেমন হয়? দাদা বললেন, ঝেড়ে কাশো।

তাঁকে একটা পরিকল্পনা দিলাম। যেহেতু আমাদের কাস্টমার বেইজটা (base) হচ্ছে স্কুলের বাচ্চারা, তাই আমরা শুরুতেই বাংলাদেশের শহর অঞ্চলের A ক্যাটাগরির স্কুলগুলোতে যাবো। স্কুলের অনুমতি নিয়ে প্রথমদিন বাচ্চাদের ছোট ছোট কিছু স্যাম্পল (sample) ফ্রিতে দেবো এবং সেদিন বলে আসবো যে, এই প্রোডাক্টটা যদি তোমাদের কারো খেয়ে ভালো লেগে থাকে, তবে তোমরা বাসা থেকে টাকা নিয়ে আসলে কিনতে পারবে। কাল আমরা স্কুলের বাইরে থাকবো। তোমাদের স্কুলের আশে-পাশের দোকানগুলোতেও আমরা প্রোডাক্টটা রেখে যাব। সেখানে খুঁজলেও পেয়ে যাবে। অথবা স্কুল শুরুর দিকে বা ছুটির দিকে বাচ্চাদের অভিভাবকদের টার্গেট করেও প্রোডাক্ট সেম্পলিং (sampling) করা যেতে পারে।

এইযে সরাসরি বাচ্চাদের কাছে চলে যাওয়া, এতে কী হবে, দেখা যাক।

১) বাচ্চা এবং অভিভাবক উভয়ের মধ্যে প্রোডাক্ট সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি হবে।

২) যেহেতু সেম্পলিং এবং ডিসপ্লে (display) করা হবে, কাজেই টার্গেটেড কাস্টমারের কাছে প্রোডাক্ট ভিসিবল হবে।

৩) যেহেতু সরাসরি কাস্টমারকে প্রোডাক্ট টেস্ট (taste) করার সুযোগ দেওয়া হবে, এতে প্রোডাক্টের সেলস এবিলিটি (sales ability) বাড়বে।

এছাড়া আমরা বাচ্চাদের ড্রয়িং, শিল্পকর্ম, কবিতা, গল্প এধরনের এক্টিভিটি রয়েছে এমন অনেকগুলো সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপ বা প্লাটফর্ম (platform) খুঁজে বের করে সেখানকার কোওর্ডিনেটরদের সাথে একটা চুক্তি সম্পন্ন করি। চুক্তিটা এমন যে, তারা প্রতি সপ্তাহে তাদের গ্রুপে নানা রকম কন্টেস্ট বা প্রতিযোগিতার আয়োজন করবে আর আমাদেরকে তাদের গিফট পার্টনার (gift partner) হিসেবে রাখবে। সেই প্রতিযোগীতা থেকে কিছু প্রতিযোগীকে খুঁজে বের করে আমরা তাদের ঘরে ঘরে পুরস্কার হিসেবে নটিলা পাঠিয়ে দেবো। যারা পাবে, তারা খুশি হবে এবং যারা পাবে না, তারা এই প্রোডাক্ট সম্পর্কে সচেতন হবে এবং পরের বার পাওয়ার জন্য আরো ভালোভাবে চেষ্টা করবে। 

এভাবে কাস্টমারের খুব কাছে গিয়ে তার সাথে সম্পর্ক তৈরি করে তার জন্য যে মার্কেটিং করা হয়, এটাকেই বলে ইম্প্যাক্ট মার্কেটিং, আর এই ইম্প্যাক্ট মার্কেটিংটা একটা বি.টি.এল ক্যাম্পেইন এর অংশ। যেহেতু আমি এজেন্সি বিজনেস করি, সুতরাং কাজের খাতিরে অনেক ক্লায়েন্ট-এর ATL এবং BTL ক্যাম্পেইন করতে হয় আমার টিমকে। গল্পের আরো ভিতরে ঢোকার আগে আপনার কাছে একটা প্রশ্ন: এ.টি.এল বা বি.টি.এল কী? এই A এবং B ছাড়াও T-ও কিন্তু উপস্থিত রয়েছে এই দলে। সেটাও কি জানেন?

বি.টি.এল মানে হলো বিলো দ্য লাইন (Below The Line)। এই লাইনের নিচ দিয়ে মার্কেটিং করার মানে হলো একদম খুজে খুজে সঠিক কাস্টমারকে টার্গেট করতে পারা এবং একটা টেইলর মেইড (tailor made) পরিকল্পনা তৈরি করতে পারা। 

অন্যদিকে এ.টি.এল মানে হলো এবাভ দ্যা লাইন (Above The Line)। আর এই লাইনের উপর দিয়ে মার্কেটিং করার মানে হলো, একদম টার্গেটেড কাস্টমারকে প্রোডাক্ট বা ব্র‍্যান্ড সম্পর্কে ইনফরমেশন না পৌছে দিয়ে বরং বিগার অডিয়েন্স-এর কাছে ইনফরমেশন পৌছে দেওয়া। অর্থাৎ মাস কমিউনিকেশনের জন্য এ.টি.এল ইজ দ্যা মোস্ট এপ্লিকেবল।

এ.টি.এল ক্যাম্পেইন থেকে একটা ব্র‍্যান্ড যা কিছু পায়, তা হলো, মাস রিচ (mass reach), পিওপলস এটেনশান (people’s attention), ব্র‍্যান্ড এওয়ারনেস, ব্র‍্যান্ড রিকল ভ্যালু বৃদ্ধি এবং ব্র‍্যান্ড ভিসিবিলিটি।

এবার জানা যাক, TTL মানে কী? এবাভ এবং বিলো এর মাঝখানে কি থাকে? অবশ্যই থ্রু (through); তাই টি.টি.এল মানে হলো এ.টি.এল + বি.টি.এল ক্যাম্পেইন। অর্থাৎ দুইটা ক্যাম্পেইনের mixture কে বলে টি.টি.এল.।

হাতে কলমে ডিজিটাল মার্কেটিং প্র‍্যাক্টিস করতে চান?

এবার একটা উদাহরণ দেখা যাক, যেটা দিয়ে এক সাথে তিনটা লাইন সম্পর্কেই জানা যাবে।

ধরা যাক, আপনার বাসায় একটা বাচ্চা আছে এবং আপনি টেলিভিশনে আপনার বাসার আশে-পাশে বা কিছুটা দূরে একটা দারুণ স্কুল আছে বলে জানতে পেরেছেন। এবং সেটা জেনে আপনি সেই স্কুলে গেলেন আপনার বাচ্চাকে ভর্তি করাবেন বলে৷ তবে স্কুলে ঢুকতেই আপনি দেখতে পেলেন, দুইটা লোক সেই স্কুল সম্পর্কে আপনাকে কনসাল্ট (consult) করার জন্য বসে আছে। এই যে টেলিভিশনের যেই বিজ্ঞাপন আপনার মনের মধ্যে ব্র‍্যান্ড এওয়ারনেস তৈরি করেছে এবং যার বাসায় বাচ্চা নাই, তাকেও বিজ্ঞাপনটি টিভির মাধ্যমে দেখিয়েছে, সেটাকেই এ.টি.এল বলে। আর স্কুলে পা রাখা মাত্রই আপনাকে যে সরাসরি টার্গেট করে কনসাল্ট (পরোক্ষভাবে বিজ্ঞাপন) করেছে, সেটাকেই বি.টি.এল বলে। অর্থাৎ এ.টি.এল হলো প্রোডাক্ট কি মেসেজ দিতে চায়, সেটা অডিয়েন্স-এর কাছে পৌছে দেওয়া, আর বি.টি.এল হলো প্রোডাক্টের বিক্রি বাড়ানো।

যদি কেউ আগে থেকেই এ.টি.এল বা বি.টি.এল বুঝে থাকেন, তাকে এবার একেবারে নতুন একটা তথ্য দিচ্ছি। সালটা ১৯৫৪, Proctor & Gambol (P&G) তাদের এজেন্সিগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন প্রমোশনাল এক্টিভিটি-র জন্য ভিন্ন ভিন্ন রেটে (rate) পেমেন্ট (payment) করতো। আর তখন থেকেই P&G এর ফাইনান্স ডিপার্টমেন্ট (finance department) তাদের ফাইনান্স বইতে একটা হাইপোথিটিকাল লাইন (hypothetical line) আঁকা শুরু করে। আর সেই লাইনের উপর ওই সমস্ত মিডিয়াগুলো রাখে, যাদের এজেন্সিকে কমিশন দিতে হতো। আর লাইনের নিচে সে সমস্ত মিডিয়াগুলোকে রাখে, যেগুলোর এজেন্সিকে কোন কমিশন দিতে হতো না। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, লাইনের উপর রাখা হয়েছিলো টেলিভিশন, বিলবোর্ড, প্রিন্ট মিডিয়া, রেডিও, ম্যাগাজিন ইত্যাদি মিডিয়াগুলো, আর লাইনের নিচে রাখা হয়েছিলো ব্যানার, ফ্লায়ার, ব্রোশিওর (brochure), ইভেন্ট ইত্যাদি মিডিয়াগুলো। যদিও P&G এর ফাইনান্স টিম এই লাইনটা এঁকেছিলো তাদের ফাইনান্সিয়াল ইস্যুগুলো ক্লিয়ার রাখার জন্য, কিন্তু পরবর্তীতে ইন্ডাস্ট্রিতে এই এ.টি.এল এবং বি.টি.এল নাম দুটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।

এবার দেখা যাক, টি.টি.এল কী? টি.টি.এল হলো একটা ইন্টেগরেটেড এপ্রোচ (integrated approach), যেখানে এ.টি.এল এবং বি.টি.এল এই দুইটা স্ট্রেটেজিকে মিলিয়ে একটা স্ট্রেটেজি বানানো হয়। এই স্ট্রেটেজির উদ্দেশ্য হলো মার্কেটে একটা হলিস্টিক ভিউ (holistic view) তৈরি করা। একটা উদাহরণ দিলে এই ধারণাটা পানির মতন পরিষ্কার লাগবে। ধরা যাক, আড়ং সারা দেশ জুড়ে একটা টেলিভিশন ক্যাম্পেইন বা ইউটিউব ক্যাম্পেইন লঞ্চ করেছে, এবং সেই ক্যাম্পেইনে যার যার এলাকার জন্য লোকালি একটা প্রমোশনাল কোড (code) বা ডিস্কাউন্ট অফার (discount offer) দিয়ে দিলে সেটা হবে একটা টি.টি.এল ক্যাম্পেইন। এখানে কাস্টমারকে সচেতনও করা হলো আবার কুপন কোড দিয়ে তাকে লোকাল আউটলেটে নিয়ে গিয়ে প্রোডাক্টও সেল করা হলো। এই ধরনের আপিল (appeal) মূলত ন্যাশনালি প্রচার করা হয় এবং এর সাথে সরাসরি রেসপন্স করার ইলেমেন্ট ও জুড়ে দেওয়া হয়।

আবার এই সবগুলো চ্যানেলকে যদি একত্রিত করে কোন একটা ক্যাম্পেইন লঞ্চ করা হয়, তবে সেটাকে কী ধরনের প্রমোশন বলে অনুমান করতে পারবেন? সেটাকে বলে মাল্টি চ্যানেল (multi channel) মার্কেটিং। মাল্টি চ্যানেল মার্কেটিং ক্যাম্পেইন-এর ফ্রিকুয়েন্সি (frequency) এবং রিচ বাড়িয়ে দেয় এবং আরো ইফেক্টিভ মেসেজ তৈরি করে। কারণ কখনো কখনো রোবাস্ট (robust) মার্কেটিং ক্যাম্পেইন চালাতে সিংগেল (single) চ্যানেল ততটা কার্যকর নাও হতে পারে। ইমেইল, সোশ্যাল মিডিয়া, মোবাইল, ডিসপ্লে এড, প্রমোশনাল ইভেন্ট, টেলিভিশন এবং আরো অনেক কিছু এর অন্তর্ভুক্ত।

মাল্টি চ্যানেল মার্কেটিং এর একটা গ্রেট উদাহরণ হলো বিখ্যাত কোলা ব্র‍্যান্ড কোকাকোলার কোক জিরো (Coke Zero) এর ড্রিংকেবল এডভারটাইজিং (drinkable advertising) ক্যাম্পেইনটি। এই ক্যাম্পেইনটি পরিচালনা করতে কোকাকোলা বিলবোর্ড, টেলিভিশন এড, গেমস, স্টান্টস (stunts), নিউজপেপার, ম্যাগাজিন, মিউজিক ফেস্টিভাল, মোবাইল এপ কিছুই বাদ রাখেনি। ক্যাম্পেইনটিতে অংশগ্রহণকারী গেস্টরা পেয়েছিল হয় কোক জিরো-এর সেম্পল অথবা ফ্রি বোতল সংগ্রহ করার কুপন।

মূলত একটা গেম খেলার মাধ্যমে কোক জিরো এর স্যাম্পল অথবা ফ্রি বোতল সংগ্রহ করার কুপন বিলি করার জন্য কোকাকোলার এই মাল্টি চ্যানেল মার্কেটিংটা আয়োজন করেছিল। ক্যাম্পেইনে দেখা যায়, টেলিভিশনের পর্দায় কোকাকোলার বোতল থেকে পানীয় পড়ছে আর অন্যদিকে অডিয়েন্স-এর হাতে থাকা মোবাইল এপ্লিকেশনের মাধ্যমে অডিয়েন্স সেই পানীয় তার ফোনে উপস্থিত থাকা গ্লাসে ভরে নিচ্ছে।

এবং সেই এড এর শেষে বলা হয়েছিল: So next time when you are thirsty, drink an ad.

যদি হাতে কলমে কাজ শিখে নিজেকে মার্কেটে স্টাবলিশ করতে চান তবে এখনি এনরোল করে ফেলুন আমার প্রিমিয়াম কোর্স:

​​​​​”Digital Marketing RoadMap” এ…

Share:

"ইফেক্টিভ ফানেল স্ট্রেটিজি" ফ্রি ইবুকটি ডাউনলোড করতে নিচের ফর্মটি ফিলাপ করুন

আরো ব্লগ

লিড জেনারেশন করলে অডিয়েন্স থাকবে হাতের মুঠোয়!!

আমরা যারা অনলাইনে বিজনেস করি আমাদের সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে আমরা ম্যাসেঞ্জারে ক্লায়েন্টের সাথে ডিল ক্লোজ করতে পারি না। আমরা ম্যাসেজ তো পাই হাজারে

ভিসিবিলিটি ইজ মোর ইম্পরটেন্ট দ্যান এভেইলেবেলিটি

চা খেতে বের হয়েছিলাম। প্রথম চুমুক টা দিতেই অপর পাশের মুদি দোকানে চোখ গেলো। একজন লোক শার্ট প্যান্ট ইন করে তেলের বোতল গোছাচ্ছে। মোটামুটি ১৫/২০

লগরিদম ভাল না লাগলেও আপনাকে এলগরিদম জানাই লাগবে!!

আমরা যারা ফেসবুকের এডভারটাইজমেন্ট নিয়ে কাজ করি আমাদের সব থেকে বড় প্রব্লেমটা কি জানেন?  প্রব্লেমটা হলো আমরা লাখ লাখ টাকার এড  ফেসবুকে ঠিকই চালাই কিন্তু

আই লেভেল ইজ বায় লেভেল!

ইংরেজীতে একটা প্রবাদ আছে, Where there is will, There is a way. আর তাই কাস্টমারের সোস্যাল বিহেভিয়ার বা পারচেজ বিহেভিয়ারে প্রভাব ফেলতে দিনের পর দিন