আমার চাকরি জীবনের একটা উদাহরণ টানি। আমি যখন চাকরিতে ছিলাম, আমার বিভাগে প্রায় ১৮ টা প্রোডাক্ট ক্যাটাগরি ছিল। তার মধ্যে একটা প্রোডাক্ট ছিল আউটসোর্স (outsource) করা, যেটা কিনা নিজের পকেটের টাকা দিয়ে কিনে ক্লায়েন্টকে সেল করতে হতো। তাই আমাদের সেলস ডিপার্টমেন্ট-এর লোকেরা সবসময়ই চেষ্টা করতো ওই প্রোডাক্টটাকে যেভাবে পারা যায় সেল না করে বাসায় ফিরতে। কাউকে কাউকে এভাবে ও বলতে দেখেছি, “ভাই, আমাদের এই প্রোডাক্টটার দাম অনেক বেশি। আপনার সাথে বিজনেস করবো, তাই আপনার ভালো চেয়েই বলছি, আপনি এটা অমুক দোকানে আরো কম দামে পেয়ে যাবেন।” ক্লায়েন্ট তো কম দামের সন্ধান পেয়ে মহাখুশি, এদিকে সেলস এর বেচারাও বেচতে না পেরে মহাখুশি।
আর এই সেল না করার যে টেকনিক, এটাকে কী বলে জানেন? এটাকে বলে ডিমার্কেটিং (demarketing)। মার্কেটিং তো শুনেছি প্রচুর, কিন্তু ডিমার্কেটিং?
এক কথায় ডিমার্কেটিং মানে হলো, যদি ডিমান্ড এর তুলনায় সাপ্লাই কম থাকে বা প্রোডাক্ট এর কস্টিং বেশি থাকে বা প্রফিট কম থাকে বা সাপ্লাই চেইনে ঘাপলা থাকে তাহলে কাস্টমারকে প্রোডাক্ট কেনায় নিরুৎসাহিত করা।
সাধারণত এই কাজটা করা হয় প্রোডাক্ট-এর দাম বাড়িয়ে দিয়ে। একটা অংক কষে ব্যাপারটা আরো বোঝা যাক। ধরুন, আপনি প্রতি মাসে ১ লাখ পিস (piece) প্রোডাক্ট বানাতে পারেন, কিন্তু মার্কেটে আপনার চাহিদা রয়েছে ৫ লাখ পিস প্রোডাক্টের। প্রতি মাসে আপনার প্রোডাক্ট কিনতে এসে বাকি ৪ লাখ মানুষ হতাশ হয়ে ফিরে যায়। এতে আপনার লাভ হয় নাকি লোকসান? অবশ্যই লোকসান। আপনার ব্র্যান্ড ইমেজ-এর লোকসান।
কাস্টমার ধরেই নেবে, এই কোম্পানীর প্রোডাকশন লাইন তো খুব দুর্বল, ঠিক মতন প্রোডাক্টই সাপ্লাই দিতে পারে না।
মার্কেটিং এ আমরা কি করি? নানা রকম টেকনিক এবং টেকটিক্স ব্যবহার করে প্রোডাক্ট এর ডিমান্ড তৈরি করি এবং প্রোডাক্ট এর সেলস বাড়ানোর চেষ্টা করি। কিন্তু ডিমার্কেটিং-এ এমন কিছু করা হয় যেন মার্কেট থেকে অটোমেটিক ডিমান্ড কমে যায়। ৫ লাখ পিস-এর ডিমান্ড এক ধাক্কায় ১ লাখ পিস-এ নেমে আসে। যেমনঃ ৫ টাকার প্রোডাক্ট-এর প্রাইস যদি ৮ টাকা করে দেওয়া হয়, আপনি ধরেই নিতে পারেন, এতে আপনার ৫০% ডিমান্ড এমনিতেই কমে যাবে। তবে যারা চালাক, তারা আরো নানা টেকনিক প্রয়োগ করে কাজটা করে থাকে। যেমন, একটা ব্ল্যাক ফ্রাইডে অফার দিতে পারে। ধরুন, প্রোডাক্ট আছে মাত্র দুইটা, কিন্তু এটা কেউ জানে না। কাজেই অফার দিয়ে মানুষকে যদি জানানো যায় যে, এক অফারে সব শেষ, তাহলেই কেউ আর প্রোডাক্ট চেয়ে আপনাকে বিরক্ত করবে না, বরং মনে করবে আপনার প্রোডাক্টের অনেক ডিমান্ড। বা যে প্রোডাক্ট-টা শর্ট আছে, সেটার কাছাকাছি অন্য কোনো প্রোডাক্টে তাকে কনভার্ট করে দিয়ে ও এ কাজ করা যায়। করোনাকালে এ.সি.আই-কে দেখেছি Hexisol এর শর্টেজ এর কারণে Savlon Hand Rub এ ক্লায়েন্ট কে কনভার্ট করতে।
হাতে কলমে ডিজিটাল মার্কেটিং প্র্যাক্টিস করতে চান?
ডিমার্কেটিং-এর আসলে আরো অনেকগুলো উপায় আছে। তার মধ্যে একটা উপায় হলো Bate and Switch, এর মাধ্যমে একটা নির্দিষ্ট প্রোডাক্টে ডিস্কাউন্ট (discount) দেখিয়ে আপনাকে দোকানে নিয়ে যাবে, এবং সেই প্রোডাক্টের শর্টেজ (shortage) দেখিয়ে অন্য একটা সিমিলার (similar) প্রোডাক্ট কিনতে উৎসাহিত করবে। ক্লায়েন্টও কষ্ট করে কিনতে গেছেন, তাই ডিস্কাউন্ট-এর প্রোডাক্ট না পেয়ে আরেকটা প্রোডাক্ট কিনে ফিরে আসবেন।
ডিমার্কেটিং-এর দারুণ একটা উদাহরণ হচ্ছে সিনেমা হলগুলো। সিনেমা হলগুলোতে বন্ধের দিন এবং পিক টাইমে (pick time) টিকেট এর প্রাইস কিছুটা বেশি রাখা হয়। ফলে ওই সময়গুলোতে বহু কাস্টমার সিনেমা দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং তারা অফ পিক টাইমে রেগুলার (regular) প্রাইসে টিকেট কিনে মুভি দেখার প্ল্যান করে। আর এই টেকনিকটাকে বলে ক্রাউডিং কস্ট (crowding cost) ডিমার্কেটিং।
মার্কেটিং করতে আমরা যেমন 4P ব্যবহার করি, একইভাবে ডিমার্কেটিং করতে আমরা 4P-কে উল্টোভাবে ব্যবহার করতে পারি। আর এই উপায়টার নাম হলো Differenciation ডিমার্কেটিং।
১) প্রোডাক্ট (Product): প্রোডাক্ট-র প্রোডাকশন কমিয়ে দিতে পারি।
২) প্রাইস (Price): প্রোডাক্ট-এর প্রাইস বাড়িয়ে দিতে পারি।
৩) প্লেস(Place): সবখানে যেন প্রোডাক্ট চাইলেও না পাওয়া যায় সেটার ব্যবস্থা করতে পারি।
৪) প্রমোশন (Promotion): সেই প্রোডাক্টের প্রমোশনাল কার্যক্রম সীমিত করে দিতে পারি।
মোট কথা, ডিমার্কেটিং মানে হলো কাস্টমারকে প্রোডাক্ট কেনা থেকে নিরুৎসাহিত করা। আর এটার বিরাট একটা উদাহরণ হলো, সরকারের তরফ থেকে টোব্যাকো কোম্পানীগুলোর গায়ে সিল মেরে দেওয়া— Smoking kills.
ডিমার্কেটিংকে তিনভাগে ভাগ করা যায়:
১) জেনারেল (General) ডিমার্কেটিং: এটা করা হয় যখন কোম্পানী বা রাষ্ট্র নিজেই সেই প্রোডাক্টের সমগ্র ডিমান্ড এবং কনসাম্পশন (consumption) কমাতে চায়, যেমনটা উপরে টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে উদাহরণ টানা হয়েছে।
২) সিলেক্টিভ (selective) ডিমার্কেটিং: যখন একটা কোম্পানী একটা সিলেক্টেড ক্লাস কাস্টমারকে টার্গেট করে এবং শুধু তাদেরকেই লয়াল (loyal) এবং কোর টার্গেট গ্রুপ (core target group) বানাতে চায়, তখন তারা সিলেক্টিভ ডিমার্কেটিং মেথড প্রয়োগ করে। উদাহরণস্বরূপ বড় বড় হোটেল বা রেস্টুরেন্টগুলোর কথা ধরা যায়। তারা তাদের প্রাইসিং এতটাই এক্সক্লুসিভ (exclusive) করে রাখে যে, সাধারণ জনগণ সেই কোম্পানী বা ইন্ডাস্ট্রি থেকে দূরে থাকতে বাধ্য থাকে।
৩) স্টক আউটেজ (stock outage) ডিমার্কেটিং: এই মেথডে কোম্পানীগুলো কৃত্রিম শর্টেজ (shortage) তৈরি করে থাকে। ফলে: a limited supply of goods is created so that consumers start stocking these ‘hart to get’ products. এটার একটা বড় উদাহরণ হতে পারে ইন্ডিয়ার ‘টাটা নেনো’ গাড়িটি। টাটা নেনো তৈরির পর পর এটার ডিমান্ড এতই উঁচু ছিল যে কোম্পানীকে বাধ্য হয়ে টাটা নেনো-র বিক্রি এবং প্রমোশান দুইটাই বন্ধ করতে হয়।
আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনে ডিমার্কেটিং টেকনিকটা যেভাবে প্রয়োগ করি, সেটা বলছি। ধরা যাক, কোন একটা নির্দিষ্ট কাজ করানোর জন্য আমার কাছে কোন ক্লায়েন্ট এল। কাজের ডিটেইল শুনে বুঝলাম, এই কাজ আমার জন্য করা মুশকিলই না,বরং অসম্ভব। কিন্তু এই কথা আমি কি ক্লায়েন্টনকে বলি? বলি না। তাকে জবাব দেই এভাবে, আমি তো আসলে অন্যান্য ক্লায়েন্ট-এর কাজ নিয়ে ঝামেলায় আছি, তাই চাইলেও আপনার এই কাজটা আমি ধরতে পারছি না। ফলে, ক্লায়েন্ট আমার সম্পর্কে একটা পজিটিভ ফিডব্যাক (feedback) নিয়ে যায় যে, ইনি ব্যস্ত না থাকলে কাজটা ঠিকই করেই দিতেন। ব্যাস, এর ফলে ক্লায়েন্টও পজিটিভ থাকেন আবার আমার ব্র্যান্ড ভ্যালুও পজিটিভ থাকে।
তবে মার্কেটিং ইন্ডাস্ট্রিতে গ্রীন মার্কেটিং-কে প্রতিষ্ঠিত করতেই ডিমার্কেটিং ধারণাটা খুব বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। গ্রীন মার্কেটিং পরিচয় দিতে হবে? নাম শুনেই তো বুঝা যায়। মার্কেটিং এর এমন সব কলাকৌশল করা, যেনো পৃথিবীটা আবারো সবুজ হয়ে ওঠে, যাতে পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে, যাতে পৃথিবীতে পরের প্রজন্মের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ রিসোর্স মজুদ থাকে। আর একারণেই কিন্তু আমরা ধীরে ধীরে মার্কেটিং জেনারেশন থেকে ডিমার্কেটিং জেনারেশনের দিকে আগাচ্ছি।